Homeopathy

হোমিওপ্যাথিতে বায়োকেমিক (Biochemic) কী

বায়োকেমিক

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আজ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় এক বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর মধ্যে বায়োকেমিক চিকিৎসা (Biochemic Therapy) বা টিস্যু রেমেডি (Tissue Remedy) এক বিশেষ শাখা, যা শরীরের ভেতরে উপস্থিত বারোটি মৌলিক খনিজ লবণের ঘাটতি পূরণের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করে।

এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন জার্মান চিকিৎসক ডা. উইলহেম হাইনরিখ শ্যুসলার (Dr. Wilhelm Heinrich Schüßler)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে নির্দিষ্ট কিছু মিনারেল বা টিস্যু সল্ট থাকে, যেগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হলে রোগ দেখা দেয়। সেই ঘাটতি পূরণ করলে শরীর নিজেই সুস্থ হয়ে ওঠে।


বায়োকেমিক চিকিৎসার উৎপত্তি ও ইতিহাস

ডা. শ্যুসলার (Dr. Schüßler) ১৮৭৩ সালে তাঁর বহু বছরের গবেষণার পর বায়োকেমিক চিকিৎসা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন—

“Every disease is due to a deficiency of the inorganic salts in the tissues of the body.”
অর্থাৎ, শরীরের কোষে অজৈব লবণের অভাবই সকল রোগের মূল কারণ।

এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তিনি ১২টি টিস্যু সল্ট আবিষ্কার করেন, যা আজও বায়োকেমিক চিকিৎসার মূল স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

শ্যুসলার নিজে হোমিওপ্যাথির ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তিনি কিছুটা আলাদা পথে চলেছিলেন। তিনি ওষুধকে অতি-উচ্চ মাত্রায় না নিয়ে, বরং নিম্ন potency (৩x, ৬x, ১২x) তে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন, যাতে শরীর সরাসরি কোষীয় পর্যায়ে খনিজটি পায়।


বায়োকেমিক চিকিৎসার মূল তত্ত্ব

বায়োকেমিক চিকিৎসা তিনটি মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি:

  1. মানবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত:
    প্রতিটি কোষে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিনারেল বা টিস্যু সল্ট থাকে।
  2. রোগ মানে কোষের মিনারেল ঘাটতি:
    যদি কোনো একটি মিনারেলের পরিমাণ কমে যায়, তাহলে কোষ তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না — ফলে রোগ দেখা দেয়।
  3. চিকিৎসা মানে ঘাটতি পূরণ:
    সেই ঘাটতি পূরণ করতে টিস্যু সল্ট সরবরাহ করতে হয়, যা শরীর নিজেই ব্যবহার করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

বায়োকেমিক ওষুধের ধরন: ১২টি প্রধান টিস্যু সল্ট

ডা. শ্যুসলার ১২টি মূল টিস্যু সল্ট নির্ধারণ করেন। প্রতিটির নিজস্ব কাজ ও প্রয়োগ ক্ষেত্র রয়েছে। নিচে বিস্তারিত দেওয়া হলো:

ক্র.নামপ্রধান কার্যকারিতাসাধারণ ব্যবহার
Calcarea fluorica (Calc. Fluor)টিস্যু দৃঢ়তা বজায় রাখাহাড় দুর্বলতা, ভেরিকোজ ভেইন, ফাটল, দাঁতের সমস্যা
Calcarea phosphorica (Calc. Phos)বৃদ্ধি, শক্তি ও হাড়ের গঠনশিশুদের বৃদ্ধি সমস্যা, দুর্বলতা, দাঁত ওঠার সময়
Calcarea sulphurica (Calc. Sulph)পুঁজ ও সংক্রমণ নিরাময়ঘা, ফোঁড়া, একজিমা
Ferrum phosphoricum (Ferrum Phos)অক্সিজেন সরবরাহ ও রক্তবৃদ্ধিজ্বরের শুরু, প্রদাহ, রক্তাল্পতা
Kali muriaticum (Kali Mur)প্রদাহ ও সর্দি নিরাময়গলা ব্যথা, কফ জমে থাকা, টনসিল
Kali phosphoricum (Kali Phos)স্নায়ু শক্তি ও মানসিক স্থিরতামানসিক ক্লান্তি, অনিদ্রা, ডিপ্রেশন
Kali sulphuricum (Kali Sulph)ত্বক ও মিউকাস মেমব্রেন পুনর্গঠনস্কিন র‍্যাশ, একজিমা, দেরিতে সেরে ওঠা সর্দি
Magnesia phosphorica (Mag. Phos)ব্যথা ও খিঁচুনি নিরাময়পেট ব্যথা, মাসিক ব্যথা, মাইগ্রেন
Natrum muriaticum (Nat. Mur)হরমোন ব্যালান্স ও ত্বকত্বকের দাগ, মাথাব্যথা, সর্দি
১০Natrum phosphoricum (Nat. Phos)অ্যাসিড-ব্যালান্স ও হজমে সহায়তাঅ্যাসিডিটি, গ্যাস, পেট ব্যথা
১১Natrum sulphuricum (Nat. Sulph)লিভার ও কিডনি ফাংশন ঠিক রাখাজন্ডিস, অ্যাজমা, ফুসফুস সমস্যা
১২Silicea (Silica)কোষ শক্তিশালী করা ও বিষাক্ত পদার্থ বের করাঘা শুকানো, চুল-নখ দুর্বলতা, ঘাম সমস্যা

বায়োকেমিক ওষুধ কিভাবে কাজ করে

বায়োকেমিক ওষুধ আসলে কোষীয় খাদ্য (Cell food) হিসেবে কাজ করে। এটি কোনো রাসায়নিকভাবে শরীরে প্রতিক্রিয়া ঘটায় না, বরং কোষে মিনারেল সরবরাহ করে।
যখন কোষ তার প্রয়োজনীয় মিনারেল পায়, তখন শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জেগে ওঠে এবং রোগ নিজে থেকেই সেরে যায়।

অর্থাৎ, এটি রোগ দমন নয়, বরং রোগমুক্তির জন্য দেহের স্বাভাবিক ক্ষমতা জাগিয়ে তোলে।


ডোজ বা ব্যবহারের নিয়ম

  • সাধারণত ৩x, ৬x বা ১২x potency-তে ব্যবহার হয়।
  • প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য: প্রতিবার ৪টি ট্যাবলেট, দিনে ৩–৪ বার।
  • শিশুদের জন্য: ২টি ট্যাবলেট, দিনে ২–৩ বার।
  • জিহ্বার নিচে রেখে গলে যেতে দিতে হয়।

তবে ব্যক্তিগত অবস্থার ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।


বায়োকেমিক কম্বিনেশন (Combination Tablets)

বর্তমানে অনেক হোমিও কোম্পানি বিভিন্ন কম্বিনেশন বায়োকেমিক রেমেডি তৈরি করেছে, যেমন—

  • Bio Combination No. 1: Anaemia
  • Bio Combination No. 4: Constipation
  • Bio Combination No. 6: Cough, Cold
  • Bio Combination No. 11: Fever
  • Bio Combination No. 20: Skin Diseases

এগুলো একাধিক টিস্যু সল্ট মিশিয়ে তৈরি হয়, যা নির্দিষ্ট রোগের জন্য অধিক কার্যকর।


বায়োকেমিক ওষুধের সুবিধা

সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত
শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী সবাই ব্যবহার করতে পারে
শরীরের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারেও কোনো ক্ষতি হয় না
মানসিক ও শারীরিক উভয় দিকেই কার্যকর


কোন কোন সমস্যায় বায়োকেমিক কার্যকর

বায়োকেমিক চিকিৎসা নিচের সমস্যাগুলোতে খুব ভালো ফল দেয়:

  • হজমের সমস্যা ও গ্যাস
  • সর্দি, কাশি, জ্বর
  • নার্ভ দুর্বলতা, ক্লান্তি
  • ত্বকের সমস্যা (একজিমা, ফোঁড়া, পিম্পল)
  • মাসিক সমস্যা
  • চুল ও নখের দুর্বলতা
  • হাড়ের ব্যথা ও জয়েন্ট সমস্যা
  • শিশুদের বৃদ্ধি সমস্যা

বায়োকেমিক বনাম হোমিওপ্যাথিক ওষুধ

দিকহোমিওপ্যাথিবায়োকেমিক
উদ্ভব তত্ত্ব“Like cures like” (সদৃশ দ্বারা সদৃশ নিরাময়)“Mineral deficiency correction” (খনিজ ঘাটতি পূরণ)
উদ্ভাবকডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যানডা. ডব্লিউ.এইচ. শ্যুসলার
ওষুধের উৎসউদ্ভিদ, প্রাণী, খনিজ ইত্যাদিশুধুমাত্র মিনারেল সল্ট
প্রতিক্রিয়াশরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা উদ্দীপিত করেকোষে মিনারেল সরবরাহ করে
পটেন্সিউচ্চ মাত্রা (30, 200, 1M ইত্যাদি)নিম্ন মাত্রা (3x, 6x, 12x)

দুই পদ্ধতিই একই লক্ষ্য অর্জন করে — দেহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা, তবে পথ আলাদা।


বায়োকেমিক চিকিৎসার ভবিষ্যৎ

আজকের আধুনিক চিকিৎসার যুগেও বায়োকেমিক চিকিৎসা জনপ্রিয়। কারণ এটি—

  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত
  • সস্তা ও সহজলভ্য
  • রোগের মূল উৎসে কাজ করে

বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ আজও এই মিনারেল থেরাপিকে বিশ্বাস করে ও ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশে SBL, Dr. Reckeweg, Allen, Schwabe, Adel, HAPCO, Bakson ইত্যাদি কোম্পানির বায়োকেমিক ওষুধ সহজলভ্য।


উপসংহার

বায়োকেমিক চিকিৎসা আসলে শরীরের ভেতরের কোষীয় জীবনীশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি।
রোগ দমন নয়, বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তোলা — এটাই এই চিকিৎসার মূল দর্শন।

যে কোনো বয়সের মানুষ নিরাপদে এটি ব্যবহার করতে পারে। তাই ছোটখাটো সমস্যা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা পর্যন্ত, বায়োকেমিক চিকিৎসা আজ এক প্রাকৃতিক ও বিশ্বাসযোগ্য সমাধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *